বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ফেসবুক পোস্ট
বেগম খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জ সফরের অনেক ভিডিও দেখলাম গতকাল! আমি যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র - আমি ওনার ভিডিও গুলো দেখেছি অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে!
প্রথমত কাল দেখলাম হাসছেন - এবং স্বাস নেয়ার জন্য না থেমে এবং না হাপিয়ে গিয়ে মোটামুটি লম্বা সময় কথা বলতে পারছেন| আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম ওঁনার অক্সিজেন লাগছে না!
এই পুরো ব্যাপারটা একটা মিরাকল ছাড়া আর কিছু না | এই কিছুদিন আগে ৮০ বছর বয়েসী ৬-৭ মাস টানা আইসিইউ তে কাটালেন| ওনার কিডনি ফেইল করেছিল; হার্ট ফেইলিউর ছিল; লিভার পুরো ফেইল করেছে| লিভার ফেইলিউর এর জীবনঘাতী কমপ্লিকেশন যা যা হতে পারে সব ই তাঁর ছিল - সারা শরীরে পানি, পায়ে পানি, পেতে পানি, ফুসফুসে পানি! প্রতিদিন পেট আর ফুসফুস এর পাশ থেকে থেকে সুই ঢুকিয়ে লিটার কে লিটার কে পানি ড্রেইন করতে হতো|
ওনার দুই চেষ্টা এই চেষ্টা টিউব ঢোকানো ছিল কন্টিনিউয়াস পানি ড্রেইন করানোর জন্য| ঘাড়ের মধ্যে বিশাল মোটা ডায়ালাইসিস লাইন ছিল|
আরো কিছু কঠিন সমস্যা ছিল যেমন রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস তার কথায় পরে আসছি|
পৃথিবীর সবচেয়ে এডভান্সড আইসিঊ গুলোতে তে আমি কাজ করছি গত ২০ বছর ধরে|
আশি বছর বয়েসী একজন মানুষ এডভান্সড রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস যার লিভার ফেইল করেছে - কিডনি ফেইল করেছে; সিভিয়ার পালমোনারি হাইপারটেনশন আছে - এইদেশে আমরা আশা ছেড়ে দিতাম! বলে দিতাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার নাও - হসপিসে চলে যাও|
৮০ বছর বয়েসী একজন মানুষের লিভার ফেইলিউর একটা ওয়ানওয়ে জার্নি| বাকি সব অর্গান ডোমিনোর মতো ফেইল করা শুরু করে| রুগী বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি|
মিসেস খালেদা জিয়া যে সাত মাস আইসিঊ থেকে কাল সেনা কুঞ্জে এসে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন - আবারো বলছি এটা মেডিকেল মিরাকল| উপরিওয়ালা কোথাও কেউ নিশ্চয় আছেন; যিনি সম্ভব - অসম্ভবের কারিগর - উনিই হয়তো চেয়েছেন অসম্ভবের ঘড়ির কাটা টাকে হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে| কেউ ওনাকে এই দিনটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন! করোও কোনো পুন্য আছে কোথাও এই সম্ভব-অসম্ভবের উল্টোচালে|
আপনারা কেউ কি ওনার হাত দুটো খেয়াল করেছেন? কি ভাবে বেঁকে গিয়েছে? কনট্রাক্টেড হয়ে গিয়েছে? আমরা মেডিকেল কলেজে পড়েছি সোয়ান নেক ডিফর্মিটি; বাটোনেআর ডিফর্মিটি| গত শতব্দীর টার্ম! এই শতাব্দীর মেডিকেল স্টুডেন্ট রা এগুলো খুব একটা দেখে না এখন| রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস এর চিকিৎসা না হলে বার্ন্ট আউট হয়ে যায়| এডভান্সড রিউমাটোয়েড আর্থরাইটিস এর শেষ পর্যায়ে গিয়ে হাত গুলো এভাবে শক্ত হয়ে কুঁকড়ে যায়| দুটো হাতই শুধু অচল হয় না - অবর্ণনীয় যন্ত্রনা হয় - হাই ডোজ ইম্মিউনিটি সাপ্রেস করা মেডিসিন এ না থাকলে|
আপনি কি খেয়াল করেছেন উনি পা লম্বা করে হুইল চেয়ার এ বসে ছিলেন? উনি পা ভাঁজ করতে পারেন না! ওনাকে স্ট্র্যাপ দিয়ে হুইল চেয়ার এর সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল| যাতে পরে না যান| আমি খেয়াল করছিলাম ওঁনার ছোট পুত্রবধূ প্রতিটা মুহূর্ত শ্বাশুড়ির দিকে চোখ রাখছেন - কখন কি হয়ে যায়!
একটা জীবন চিন্তা করুন তো? অবর্ণনীয় ব্যাথার কারণে পা ভাঁজ করা যায় না - স্টিফ হয়ে গিয়েছে - হাত দুটো অচল! পুরো পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে ওনাকে! হ্যা আমি বলছি "দেয়া হয়েছে" -
এমনি এমনি হয় নি!
আগে ওনাকে যখন টিভি তে দেখেছি- তখন তো এতো খারাপ অবস্থা ছিল না| উনি এই হাত দিয়ে করমর্দন করতেন - সারাদিন ফাইল স্বাক্ষর করতেন! একটু খুঁড়িয়ে হলে হাটতে পারতেন| ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৯ ঘন্টা ক্যাম্পেইন করেছেন - সারারাত পথসভা করেছেন|
আজকাল আমরা এই ধরণের রিউমাটয়েড ডিফর্মিটি খুব কম দেখি | কারণ আজকাল রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস এর অনেক ডিজিজ মোডিফাইয়িং ঔষধ আছে| এই ঔষধ টা কন্ট্রোল করে রাখা যায়! একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান রিউমাটয়েড আর্থ্রাটিস কি এখন আর ওই পর্যায়ে পৌঁছতে দেয় না|
কিন্তু উনি যেই চার পাঁচ বছর জেলে ছিলেন - তখন তাঁর উপর গরুর চিকিৎসা হয়েছে - মানুষের চিকিৎসা হয়নি| উনি আধুনিক কোন চিকিৎসা পান নি! যেই ঔষধ দেয়া হয়েছে - তাতে ওনার ডিজিজ কন্ট্রোল তো হয়ই নি - লিভার - কিডনি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে|
২০০৭ এর পর থেকে ওনার পরিবারের উপর যা গিয়েছে যা ট্র্যাজিক মহাকাব্য| বড় ছেলেকে মেরে তার কোমর ভেঙে দেয়া হয়েছিল - তার দশ বছর লেগেছে স্বাভাবিক ভাবে হাটতে! আরেক ছেলের উপর ( যে রাজনীতির র এর সাথে জড়িত ছিল না) তার উপর কি ঝড় গিয়েছে আল্লাই জানে - ছাড়া পাবার কিছুদিন পর ৪৫ বছরের সুষ্ঠ তরুণ ক্রিকেট প্লেয়ার মানুষ টা ধুম করে মরে গেলেন|
এই কাজগুলো যারা করেছেন - যাদের সিদ্ধান্তে হয়েছে - যারা এক্জিকিউট করছেন - তাদের কে জিয়া পরিবার ক্ষমা করলেও এই দেশের একটা বিশাল অংশ মানুষ কোনোদিন ই ক্ষমা করবে না!
আরেকটা কথা -
মিসেস খালেদা জিয়ার এখন কি উচ্চও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া উচিত? আমার মতে এখন এটা পলিটিকাল ও পারিবারিক ডিসিশন;মেডিকেল ডিসিশন না|
ওনার যে মেডিকেল টিম - তাঁদের অনেক কে আমি চিনি! ওঁদের উপর আমার ১০০% আস্থা আছে| আমি মনে করি উনারাই যথেষ্ট| ওনাকে টেনে হিঁচড়ে বিদেশে নেবার কোন যুক্তি বা মেডিকেল নেসিসিটি আমি দেখি না| এটা আমার ব্যক্তিগত মত| ওনার পরিবার আরো ভালো বুঝবেন|
আশা করি মিসেস জিয়া দীর্ঘজীবী হন! আরো অনেক দিন বেঁচে থাকুন| এবং টানা হেঁচড়া ধাক্কা ধাক্কি ছাড়া নিজের বাড়িতে একটু শান্তিতে থাকুন|
She served her nation with the last bit of her strength| She has done her duty. And she has done that darn well. Let her rest now!
রুমি আহমেদ
অধ্যাপক, ডেল মেডিকেল স্কুল
ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিন